‘তুই আমার ক্ষমতা কত জানিস’ | ১০ বছরের গবেষণা মুহূর্তে ধ্বংস
রাজশাহীর তানোরে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক বিজয়ী কৃষক নুর মুহাম্মদের ১০ বছরের ধান গবেষণা কার্যক্রম নষ্ট করে দিয়েছেন পৌর যুবলীগ নেতা আব্দুল ওয়াহাব। তিনি তানোর পৌরসভা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক।
গত সোমবার যুবলীগ নেতা ওয়াহাব ক্ষমতার দম্ভে নুর মোহাম্মদের সামনেই তার গবেষণার জমিতে পাকা ধানের ওপর ট্রলি চালিয়ে দেন।
নুর মোহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জমিতে তিনি ৬২টি জাতের ধান আলাদাভাবে চাষ করেছিলেন। সবগুলো জাতের ধান এখন একটি অন্যটির সঙ্গে মিশে গেছে। এতে তার ১০ বছরের গবেষণা বিফল হয়ে গেল।
তবে এই ঘটনায় আজ বুধবার পর্যন্ত পুলিশ মামলা নেয়নি। স্থানীয়রা জানান, এই যুবলীগ নেতা এখন নুর মোহাম্মদকে সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
নুর মোহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তোর মাঠে ট্রলি চালালে তুই কী করবি? তুই আমার ক্ষমতা কত জানিস—এই কথা বলে আমার গবেষণার ধান নষ্ট করে দেয় ওয়াহাব।' ওয়াহাবের লোকজন তাকে এসময় তার গবেষণা মাঠের পাশে আটকে রেখে মারধর করেন।
তানোর থানায় করা অভিযোগে নুর মোহাম্মদ ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
১০ বছরের গবেষণা
প্রায় ৬০ বছর বয়সী নুর মোহাম্মদ মাধ্যমিক পাস করার পর থেকেই ধান চাষ শুরু করেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে খরায় ধান নষ্ট হতে দেখে তিনি গবেষণা শুরু করেন। তিনি তার মাটির বাড়িকে পরিণত করেন গবেষণাগারে। এই কাজে সরকারি কারিগরি সহায়তাও পেয়েছেন তিনি।
এ পর্যন্ত নুর মোহাম্মদ ২০০টি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন যার মধ্যে অন্তত পাঁচটি খরা সহনশীল। নতুন এই জাতগুলো সরকারি স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছে। গত ১০ বছর ধরে তিনি ৬২টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করছেন৷
কৃষিতে অবদানের জন্য নূর মোহাম্মদ ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার পান।
তিনি জানান, 'একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা জন্য কমপক্ষে ১৪ বছরের গবেষণা প্রয়োজন।'
দুই বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন নুর মোহাম্মদ। এর মধ্যে কিছু ধান কেটে শুকানোর জন্য জমিতে ফেলে রেখেছিলেন। কিছু ধান এখনও না পাকায় অপেক্ষায় আছে। তার খেতের পাশেই যুবলীগ নেতা আব্দুল ওহাব ও তার অনুসারী অঞ্জন মালাকার ও মো. টিটুর ধানখেত। সোমবার বিকেলে অঞ্জন মালাকার তার কাটা ধান ট্রলিতে বোঝাই করে গবেষণা মাঠের উপর দিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হলে নুর বাধা দেন। ট্রলির সামনে দাঁড়িয়ে নুর অঞ্জনকে জমির অন্য পাশ দিয়ে ট্রলি নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। এ সময় যুবলীগ নেতা ওয়াহাব সেখানে গিয়ে নুরকে হুমকি দিয়ে গবেষণা মাঠের ওপর দিয়ে ট্রলি চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ওয়াহাব তার লোকদের নুরকে ধরে ট্রলির পথ থেকে সরিয়ে দিতে বলে। এসময় তাকে ধরে মারধরও করা হয়।
সেদিন রাতেই নুর মুহাম্মদ তানোর থানায় গিয়ে ওয়াহাব, অঞ্জন ও টিপু এবং অজ্ঞাতপরিচয় ২৫ জনকে আসামি করে অভিযোগ দেন।
বুধবার বিকেলে থানার ওসি রকিবুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা মামলা হিসেবে নুরের অভিযোগ এখনো নথিভুক্ত করেননি।
তিনি বলেন, 'তার (নূরের) নির্দেশে আমি মামলা রেকর্ড করিনি। তিনি আমাকে মামলাটি রেকর্ড করার জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেন যাতে তারা সালিসের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারেন।'
'এছাড়া, পুলিশকে অভিযোগ রেকর্ড করার আগে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে হবে। কিন্তু ইউপি নির্বাচনের কাজে পুলিশ ব্যস্ত থাকায় এটি করতে পারেনি।'
যুবলীগ নেতা ওয়াহাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যতটা দেখানো হচ্ছে ঘটনা ততটা বড় নয়। তিনি (নুর) সামান্য বিষয়ে বাড়াবাড়ি করছেন।'
তার দাবি, 'তার খেতের কিছু ধানের লাইন এলোমেলো হয়ে মিশে গেছে, এটা খুব বড় কিছু নয়।'
নুর মুহাম্মদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'ওসি ও ওয়াহাবের দাবি সত্য নয়। মামলা করতে দেরি করতে চাইলে কেন আমি সেদিনই পুলিশের কাছে অভিযোগ দেবো?'
'আমার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। এটি শুধু গবেষকরাই বুঝবেন। গবেষণা শেষ হতে আর মাত্র চার বছর লাগত। এখন আমাকে আবার ১০ বছর আগে থেকে শুরু করতে হবে।'
Comments
Post a Comment