বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ ভাগ এলাকা ‘পানি সংকটাপন্ন’: গবেষণা



কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।

ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং পানি সংকটাপন্ন অঞ্চলগুলোর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে 'উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং' শীর্ষক গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং জুন মাসে ওয়ারপো কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

১৯৯০, ২০০০, ২০১০ ও ২০২১ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির স্তর

সরকার ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) যৌথ অর্থায়নে আগস্ট মাসের প্রথমদিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন, ওয়ারপোর মহাপরিচালক রেজাউল মাকসুদ জাহেদী।

এই জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য, গবেষণাটিতে পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে সংকটের তীব্রতা অনুযায়ী বিকল্প হিসেব ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস্য ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠের পানির সম্মিলিত ব্যবহার উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর হটস্পট হিসেবে বিবেচিত উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিসম্পদ সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন গবেষণা পর্যালোচনার সঙ্গে জড়িত অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান।

তিনি বলেন, 'বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবন পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ক্ষয়িষ্ণু পানিসম্পদগুলো দ্রুত পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা জরুরি।'

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে এ অঞ্চলের গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৮ মিটার। তবে তখনই গোমস্তাপুর ও তানোর উপজেলার অল্প কিছু এলাকায় সর্বোচ্চ স্তর ছিল ২১ মিটার।

খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষ এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে, ২০১০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির গড় স্তর ১৫ মিটার ছাড়িয়ে যায়।

২০২১ সালের মধ্যে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ১৮ মিটারে বৃদ্ধি পায় এবং কিছু কিছু এলাকা যেমন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে একটি স্থানে সর্বোচ্চ ৪৬.৮৭ মিটার রেকর্ড করা হয়।

উল্লেখ্য, গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি বলতে ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাসকে নির্দেশ করে।

গবেষনায় আরও উল্লেখ আছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনেরও অবদান আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম বৃষ্টিপাত, খরা ও ভূগর্ভস্থ পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে।

পানি সংকটাপন্ন এলাকা চিহ্নিতকরণ

গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানির বিস্তারিত মূল্যায়ন করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলাধার যাকে অ্যাকুফার বলা হয়, সেখানে বালিকণার ফাঁকে ফাঁকে পানি জমে থাকে। ভূপৃষ্ঠের পানি ও বৃষ্টিপাত মাটির মধ্য দিয়ে অ্যাকুফারে প্রবাহিত হয়। অ্যাকুফারগুলোতে বর্ষা মৌসুমে যে পরিমাণ পানি জমা হয় তা রিচার্জ হিসেবে ধরা হয়। গবেষণায় অ্যাকুফারগুলোতে পানির প্রকৃত রিচার্জ এবং সেখান থেকে কতটুকু পানি উত্তোলন নিরাপদ তা নির্ণয় করা হয়েছে এবং তাকে পানির নিরাপদ ফলন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভূগর্ভস্ত পানির প্রকৃত রিচার্জ ও পানির নিরাপদ ফলন মূল্যায়ন করে গবেষণায় ২৫টি উপজেলায় পানির সংকট পরিস্থিতি নির্ধারণ করা হয়েছে। পানি সংকট বলতে শুস্ক মৌসুমে ব্যবহারযোগ্য পানি প্রাপ্যতার তুলনায় পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া বোঝানো হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাসের কারণে এই সংকট তৈরি হয়।

দেখা গেছে, এই অঞ্চলের মোট ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ৮৭টি ইউনিয়নকে 'অতি উচ্চ' ও 'উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

পানি সংকটাপন্ন এই ইউনিয়নগুলোতে অপর্যাপ্ত অ্যাকুফার রিচার্জের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আগের বর্ষা থেকে পরের বর্ষায় হ্রাস পায়। অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পোরশা উপজেলার ৬ ইউনিয়নের সবগুলো এবং নাচোল উপজেলা ৪ ইউনিয়নের সবগুলো। যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে।

এ ছাড়া গোদাগাড়ী, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর, সাপাহারসহ ৯টি উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়নও অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

আলোচ্য ৩ জেলার ৪০টি ইউনিয়নকে 'উচ্চ পানি সংকটাপন্ন' ও ৬৫টি ইউনিয়নকে 'মাঝারি পানি সংকটাপন্ন' এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় পানিসম্পদ যথেষ্ট সংকটের মধ্যে রয়েছে।

কিছুটা ইতিবাচক দিক থেকে এই অঞ্চলে ২৮টি ইউনিয়ন 'কম পানি সংকটাপন্ন' ও ৩৪টি 'খুব কম কম পানি সংকটাপন্ন' এলাকা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বলা হয়েছে এসব এলাকায় পানি সংকট এখনো গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

অ্যাকুইফার জোন

গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলটি প্রধানত একক বা দ্বৈত অ্যাকুইফার বিশিষ্ট্য। এ অঞ্চলের বাইরের এলাকাগুলোতে একাধিক অ্যাকুইফার রয়েছে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, পোরশা ও সাপাহার উপজেলার তেঁতুলিয়া, চাওর ও গাঙ্গুরিয়া ইউনিয়নে ৪৪৫ মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করে কোনো অ্যাকুইফার পাওয়া যায়নি।

তানোরের বাধাইর ইউনিয়ন, নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কিছু অংশ এবং গোমস্তাপুর উপজেলায় ৪২৬ মিটার গভীরে ৬ থেকে ১৬ মিটার পুরুত্বের একটি মাত্র পাতলা অ্যাকুইফার আছে, যা এই এলাকাগুলোর একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কাজ করে।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু ভূগর্ভস্থ পানির নমুনায় বাইকার্বোনেট, আয়রন এবং ম্যাঙ্গানিজ দূষণ অনুমোদিত মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় দেখা গেছে, আর্সেনিক দূষণ শুধু রানিহাটি ইউনিয়নে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

সংকট সমাধানের প্রস্তাবনা

এই সমস্যাগুলো অবিলম্বে সমাধানের জন্য গবেষণায় ভূপৃষ্ঠের পানির জলাধার খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং বিদ্যমান নদী, বিল এবং পুকুর পুনঃখননের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া প্রতিবেদনে পানির সংকটাপন্ন এলাকায় পানি-নিবিড় বোরো ফসলের বিকল্প হিসেবে কম পানি ব্যবহার করা হয় এমন ফসলের চাষ উৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

পরিশেষে, গবেষণাতে এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলাধার পুনরায় পূরণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির কৃত্রিম রিচার্জ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।


Comments

Popular posts from this blog

Smugglers-BDR Affair on Barendra Express

Hijbut holds meeting under police protection