পরমত সহিষ্ণুতা


আমার কাছে গণতন্ত্র মানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক পক্ষ নেবার এবং না নেয়ার অধিকার। নাগরিকদের এই ক্ষমতাগুলোর উপর রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে। 

বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্র বলতে আমি আমেরিকা বুঝি। আমার এক নিকটাত্মীয় ডিভি লটারিতে আমেরিকায় গিয়েছে আজ অনেক বছর হল। তার যাবার পাঁচ বছর পর সে দেশে বেড়াতে আসলে আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমেরিকা কেমন। উত্তরে সে বলেছিল, 'আমেরিকা পৃথিবীর বুকে একটা স্বর্গ। বিদ্যুত কখনো যায় না, মানহীন পন্য নেই, যাতায়াতের সমস্যা নেই, যা ইচ্ছা করতে পারবা, যা বলতে চাও পারবা। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, আমার মেয়ে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনায় যত আগ্রহী তাতে আমি অবাক!’ সেই থেকে উন্নত রাষ্ট্রের একটা চিত্র আমার মনে গেঁথে আছে।

আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের সাথে আমি অপরিচিত নই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তাদের পক্ষ নেয়া কয়েক দশকের লালিত বৈশিষ্ট্য। আর তাই গতকাল নিউ ইয়র্ক টাইমসে ট্রাম্পের পক্ষ নেয়া দেখে আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছি পক্ষ নেয়ার ধরণে। এনওয়াইটির সম্পাদকমন্ডলী এক মতামতে ট্রাম্পকে ভোট না দিতে আহবান জানিয়ে লিখেছে ‘ট্রাম্প নেতৃত্ব দিতে অক্ষম’, ‘ট্রাম্প গণতন্ত্রের জন্য হুমকি,’ ‘ট্রাম্প সীমাহীন মিথ্যা বলে,’ এবং আরো লিখেছে, ‘আরেকটি ট্রাম্প যুগ পরিবেশ ধ্বংস করবে, বন্ধুত্ব নস্ট করবে ও স্বৈরাচারদের শক্তিশালী করবে।’

এখন বলেন, অবাক হবোনা? এরকম কি আমরা পারব? কিংবা আমাদের চারপাশে কোথাও কেউ? অথবা এমন পক্ষ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোর টিকে থাকার নিশ্চয়তা আছে? ভাল উদাহরণ খুব কম। যা আছে তা ইনিয়ে বিনিয়ে বহু দূরের। দুদিন পরে যার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা আছে তার বিরুদ্ধে এত স্পষ্ট অবস্থান নিঃসন্দেহে সাহসিকতা। উদার রাষ্ট্রীয় নীতি ও সহিষ্ণুতাও প্রশংসার দাবী রাখে। 

শুধু এনওয়াইটি নয়, কমলা হ্যারিসের পক্ষ নিয়েছে দি নিউ ইয়র্কার, দি বোস্টন গ্লোব সহ আরো কিছু সংবাদপত্র। একইভাবে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছে নিউ ইয়র্ক পোস্ট, ও দি ওয়াশিংটন টাইমস।  

আবার লস এঞ্জেলস টাইমস, এবং দি ওয়াশিংটন পোস্ট এই প্রথবারের মত রীতি ভেংগে কোন পক্ষে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। এজন্য তারা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। দি ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকমণ্ডলী কমলা হ্যারিসের প্রতি সমর্থন  ড্রাফট করার পরও সেটা ছাপা হয়নি। তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণে তারা দুই লাখেরও বেশি ডিজিটাল পাঠক হারিয়েছে। তাদের সম্পাদকীয় বিভাগের সম্পাদক সহ সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ও কলামিস্টদের অনেকে পদত্যাগ করেছে। 

এই পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক ধনকুবের জেফ বেযোস একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সঠিক সাংবাদিকতার স্বার্থে এবং পাঠকদের আস্থা অর্জনের জন্য তিনি নীতিগতভাবে এখন থেকে কোন পক্ষ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেফ বেযোস অ্যামাজনেরও মালিক। তিনি বলেছেন, তার সিদ্ধান্তের পিছনে তার ব্যাবসার প্রতি কোন হুমকি নেই এবং কোন সমঝোতা (quid pro quo বা এটার বিনিময়ে ওটা) নেই। তিনি আরও বলেছেন, পক্ষ নিলে পক্ষপাত ও স্বাধীনতাহীনতা প্রকাশ পায়।

নির্বাচনে কোন প্রার্থীকে সমর্থন সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠতার উপর প্রভাব ফেলে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে, চলছে। আমার কাছে এটা গ্রামের মাতবর, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সমর্থনের মত মনে হয়। সমর্থন সুচিন্তিত হলে জনগণের ভাল, অন্যথায় ভোগান্তি। আমি সে বিতর্কে যাচ্ছি না। আমি পক্ষ নেয়া না নেয়ার অধিকারে সীমাবদ্ধ থাকছি।

অতীতে হাসিনার সরকার প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কে ‘মানুষের শত্রু’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল। এখন এই পত্রিকাগুলোকে বলা হচ্ছে আওয়ামী দোসর। আচ্ছা, সেটা কেউ বলতেই পারে, বয়কট করার অধিকারও আছে। কিন্তু অফিস ঘেরাও, আগুন জালিয়ে দেয়ার হুমকি এগুলো কি শুভ লক্ষণ? এর পিছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকা অমুলক না। মামলায় জড়িয়ে কলম ঘুরানোর প্রয়াস আমাদের অতি নিকট অভিজ্ঞতা। 

মিডিয়া টিকে থাকতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি সরকারেরও মিডিয়ার সমর্থন প্রয়োজন। জেফ বেযোস যেমন বলেছেন, ‘বাস্তবতা হল এক অপরাজেয় চাম্পিয়ন।’ :D 

আমি একসময় Succession টিভি সিরিজে আসক্ত হয়েছিলাম। যদিও কল্পিত, তারপরও কল্পনারো তো বাস্তবতার নিরিখ লাগে। সেখানে আরও অনেক গল্পের সাথে ফুটে উঠেছে মিডিয়া বনাম সরকার ইস্যু, কিভাবে মিডিয়া সরকারে প্রভাব বিস্তার করে, সরকার কিভাবে মিডিয়াকে নিজের কাজে লাগায়, ভিন্নমতের সরকারের সময় মিডিয়া কিভাবে ব্যয় সংকোচন করে ইত্যাদি। এসবই জনসাধারণের ভাগ্যে প্রভাব ফেলে।  

যাহোক, জেফ বেযোসের ব্যাখ্যা সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটা মাইলফলক হবে কিনা সেটা সময় বলে দিবে। তবে তার যুক্তিগুলো যে ভিত্তিহীন নয় তা বলা যায়। এক হিসাবে দেখা যায়, জনসংখ্যার অনুপাতে আমেরিকায় সংবাদপত্র পাঠকের হার মাত্র ছয় শতাংশ। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা এখনো বেশ ভাল। আমাদের সংবাদের পাঠক, গ্রাহক ও অনলাইন ব্যবহারীদের মোট হার ১২ শতাংশ। তবে আমেরিকার মত আমাদের এখানেও এই হার কমছে। অর্থাৎ, আস্থা হারাচ্ছে গণমাধ্যম।

পাঠকের আস্থা ফেরাতে কি করা দরকার? জেফ বেযোস তার ব্যাখ্যায় একটা চমৎকার উদাহরন দিয়েছেন। তিনি সংবাদপত্র কে ভোটিং মেশিনের সাথে তুলনা করেছেন। বলেছেন, একটা ভোটিং মেশিনের যেমন সঠিকভাবে ভোট গণনার শক্তি থাকতে হয় এবং ভোটারদেরও সেই মেশিনের উপর আস্থা রাখতে হয়, তেমনি একটা সংবাদপত্রকেও সঠিক পথে থাকতে হয় এবং তার উপর মানুষের আস্থা থাকতে হয়।

আস্থা অর্জন ও আস্থা রাখার পাশাপাশি আমাদের দেশের জন্য আরও যোগ করা দরকার পরমত সহিষ্ণুতার ক্ষমতা অর্জন। নাগরিকের কথা যদি না শোনা হয়, রাষ্ট্র কিভাবে তার কর্মপন্থা নির্ধারন করবে? নাগরিকের অনুভুতি না বোঝার ফলাফল আমাদের চোখের আড়ালে যায়নি এখনও। রাষ্ট্রের উন্নতি চাই বলা আর ভিন্নমত দমন সাংঘর্ষিক। 

এনওয়াইটির সমর্থনঃ https://www.nytimes.com/interactive/2024/11/02/opinion/vote-harris-2024-election.html#

জেফ বেযোসের ব্যাখ্যাঃ https://www.washingtonpost.com/opinions/2024/10/28/jeff-bezos-washington-post-trust/ 

Comments

Popular posts from this blog

Smugglers-BDR Affair on Barendra Express

Hijbut holds meeting under police protection