অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজে




স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের বেশ কয়েকটি অপ্রকাশিত প্রবন্ধ কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে সংরক্ষণ করে চলেছেন তার প্রদৌহিত্র অভিজিৎ গোস্বামী মৈত্রেয়।

অভিজিৎ গোস্বামী গত ১৬ বছর ধরে ভারতের গ্রন্থাগার ও প্রকাশনা সংস্থায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা কপি থেকে প্রবন্ধগুলো হাতে অনুলিপি করছেন।

তার সংগ্রহে থাকা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ১৮৩ প্রবন্ধের মধ্যে ১১৩টি কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এর মধ্যে ৪৩ প্রবন্ধ ইংরেজিতে লেখা।

অভিজিৎ গোস্বামী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথমদিকে লেখা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের ওপর প্রবন্ধগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।'

'কারণ, প্রবন্ধগুলোয় শিলালিপি ও অন্যান্য প্রামাণিক দলিলের মাধ্যমে পাল ও সেন আমলের প্রাচীন গৌড় ও বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাঙালির জাতীয়তাবোধ গঠনে প্রবন্ধগুলোর ভূমিকা আছে।'

অভিজিৎ গোস্বামী পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার বাবু জগজীবন রাম মেমোরিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ৯৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহী এসেছিলেন গত ৯ ফেব্রুয়ারি।

অভিজিৎ গোস্বামী গত রোববার রাতে রাজশাহীতে ৩ দিনের সফর শেষে ভারতে ফেরার সময় ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন।

রাজশাহীর চিত্র পরিচালক আহসান কবির লিটনের বাসায় বসে অভিজিৎ গোস্বামী বর্ণনা করেন কিভাবে তিনি ১৬ বছর ধরে ভারতের গ্রন্থাগার ও প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রবন্ধগুলো হাতে লিখে সংগ্রহ করেছেন।

তিনি বলেন, 'অন্য সবার মতো প্রথমে জানতাম অক্ষয় কুমারের মোট ৩ বই আছে— 'সিরাজুদৌলা,' 'মীর কাশেম' ও 'ফিরিঙ্গি বণিক'। এগুলো গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স থেকে প্রকাশিত।

'গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় প্রেস যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন অক্ষয়কুমারের ছেলে বিজয়কুমার মৈত্রেয় সেখান থেকে বইগুলোর শেষ কপি সংগ্রহ করেন। সেগুলো তিনি স্ত্রী রেনুকণা দেবীকে উপহার দেন। আমি ওই বইগুলো নিয়েই ছিলাম।'

পরে গোস্বামীর এক জেঠাতো ভাই তাকে জানান যে নাটোরের রানী 'রানী ভবানী' নামে অক্ষয়কুমারের একটি বই আছে খরদহ জেলা লাইব্রেরিতে।

সেখান থেকে তিনি বইটা পড়ারও সুযোগ করেতে পারেননি।

'রানী ভবানী' প্রকাশ করেছিল সাহিত্যলোক প্রকাশনী।

কলকাতা কলেজ স্ট্রিটে শহীদ কারবালা ট্যাংক এলাকায় সাহিত্যলোক প্রকাশনীর অফিসে গিয়ে তার পরিচয় হয় প্রকাশক নেপাল চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে। তিনি শুধু 'রানী ভবানী' নয়, 'সাগরিকা,' 'গৌড়ের কথা' বইগুলো তাকে দেন।

'তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে তাহলে কি আরও কিছু বই আছে? এর উত্তর খুঁজতে আমি ভিক্ষুকের মতো পথ চলতে শুরু করলাম,' যোগ করেন তিনি।

'কলেজ স্ট্রিটে বৈকুন্ঠপুর তারকা পুস্তকালয় লাইব্রেরি থেকে পরামর্শ পেলাম বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে খোঁজ নেওয়ার।'

'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে গিয়ে যখন আমি তাদের ক্যাটালগ দেখলাম তখন আমার চোখ ছানাবড়া। দেখলাম, তার আরও বেশ কয়েকটি বই আছে।'

'সেখানকার প্রুফরিডার দেবপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম অশোক উপাধ্যায়। এই নামেই সাহিত্য রচনা করেন। তিনি চলমান বিশ্বকোষের মতো। তিনি জানেন, কোন পত্রিকায় কার লেখা ছাপা হয়েছে। তিনি আমাকে বললেন, তুমি এতদিন পরে এসেছ দেখি তোমার জন্য কী করা যায়।'

'উনি আমাকে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ভারতের সাহিত্য সাধক চরিতমালা" সংগ্রহের কথা বললেন।'

'সেখানে আমি অক্ষয়কুমারের প্রায় সব বইয়ের সন্ধান পাই। কিন্তু বইগুলো যাদের কাছে পেলাম তারা বললেন যে ফটোকপি করা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না, পারলে আপনি হাতে লিখে নিন।'

'এইভাবে আমি এক লাইব্রেরি থেকে আরেক লাইব্রেরি ঘোরাঘুরি করে বইগুলো হাতে লিখে সংগ্রহ করতে থাকি।'

'রাজশাহীর ঘোড়ামাড়ার বাণী প্রেস থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত "ঐতিহাসিক চিত্র" খুঁজতে গিয়ে দেখলাম। এর প্রথম পাতার পর কয়েকটি পাতা নেই, ছেঁড়া। তারপর আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে সেখানে কয়েকটা অংশ পেলাম। আবার উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি থেকে আরও কয়েক পাতা জোগাড় করলাম।'

'ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লাইব্রেরি "ঐতিহাসিক চিত্র"কে ঐতিহাসিক জার্নাল ও দুষ্প্রাপ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।'

অর্ধেন্দু কুমার গাঙ্গুলী সম্পাদিত রূপম পত্রিকায় চিত্রকলা ও প্রত্নতত্ত্বের ওপর অক্ষয়কুমারের কয়েকটি ইংরেজি প্রবন্ধ ছিল। সেগুলো পেতে আমাকে খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক লাইব্রেরিতে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে রামমোহন লাইব্রেরির একটি ঘরে ঝুড়ির মধ্যে পড়েছিল।'

বইগুলো খুঁজতে গিয়ে অভিজিৎ গোস্বামী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে মিউজিওলজিতে ডিগ্রি নেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে ডকুমেন্টেশন শিখার জন্য।

'এভাবে আমি ইংরেজি প্রবন্ধগুলো উদ্ধার করি।'

তিনি নাটোরের "দিঘাপতিয়ার রাজপরিবার" বই খুঁজে পান কলকাতার টাউন হল লাইব্রেরিতে।

১৯০২ সালে যখন লর্ড কার্জন বরেন্দ্রভূমিতে আসবেন, তখন তাকে আগে থেকে জানানোর জন্য বরেন্দ্রভূমি সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় 'দ্য গৌড় আন্ডার দ্য হিন্দুস' লিখেছিলেন।

'এই বইটা খুঁজে পেতে আমার ৬ বছর লেগেছে। সেটা আমি পেয়েছি ভারতের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে।'

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ৩টা বক্তৃতা আছে। একটা হলো: 'ফল অব পালা এম্পায়ার'। বক্তৃতাটি ১৯১৬ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে দেওয়া হয়।

১৯৮৬ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকারের সম্পাদনায় বইটা বের হয়। এখানে পাল সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে লেখা আছে। এর গুরুত্ব অনুধাবন করে রমেশচন্দ্র মজুমদার এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। বইয়ের শিরোনাম ছিল 'পাল সাম্রাজ্যের পতন'।

১৯২১ সালে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে দেওয়া বক্তৃতা 'এনসিয়েন্ট মনুমেন্টস অব বরেন্দ্র' রাজশাহীর বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি প্রকাশ করেছিল। বরেন্দ্র অঞ্চলের খননগুলো এতে বর্ণনা কর হয়েছে।

'অক্ষয়কুমার পাথরের শিলালিপির প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে প্রবন্ধগুলো লিখেছিলেন। উনার কাজ ছিল পাল ও সেন যুগের ওপর ভিত্তি করে। তিনি শুধু বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ঐতিহাসিক কলঙ্কমোচন করেননি, তিনি লক্ষণসেনের পলায়ন কলঙ্ক নিয়ে লিখেছেন, অন্ধকূপ হত্যা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অংশ নিয়েছেন ও প্রাপ্ত শিলালিপিগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।'

'সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই এগুলো সংগ্রহ করেছি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় আজ হারিয়ে যেতে বসেছেন। অথচ তিনি কত প্রাসঙ্গিক,' বলেন অভিজিৎ গোস্বামী।


Comments

Popular posts from this blog

Smugglers-BDR Affair on Barendra Express

Hijbut holds meeting under police protection