আলতাদীঘি সংস্কার: সমীক্ষা ছাড়াই কাটা হয়েছে হাজারের বেশি গাছ
জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান নিয়ে কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই নওগাঁর প্রাচীন আলতাদীঘি পুনর্খনন ও সংস্কারকাজ করেছে বন বিভাগ।
এ কাজের জন্য আলতাদীঘির পাড়ের এক হাজারের বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বন বিভাগের এমন কর্মকাণ্ডে পরিবেশবাদীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, ক্ষোভের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে যাওয়া দুটি ছবিতে দেখা গেছে, পুনর্খনন ও সংস্কার প্রকল্পের তিন বছরে আলতাদীঘির মাঝের পুকুরসহ একটি ছায়াঘেরা সবুজ এলাকা মরুভূমির চেহারা পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বহু শতাব্দী ধরে আলতাদীঘি ও এর আশেপাশে বেড়ে ওঠা একটি সুসংহত বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে এ প্রকল্প।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাবরিনা নাজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ক্ষতি অকল্পনীয়। কারণ আমরা কী হারিয়েছি তার কোনো তথ্য নেই।'
'আমরা হয়তো এমন কিছু প্রজাতি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি, যেগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। ইতিহাসের সাক্ষী ছিল আলতাদীঘি, যা এখন আর নেই,' বলেন তিনি।
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক নিদর্শন আলতাদীঘির আয়তন ৬৫২ দশমিক ৩৭ একর। এর মাঝের ১২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২০০ মিটার প্রস্থের পুকুরটির আয়তন ছিল ৪২ দশমিক ৮১ একর।
আলতাদীঘিকে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে, রাজা রামপালের রাজত্বকালে (১০৭৭-১১৩০) পুকুরটি খনন করা হয়েছিল। বন বিভাগের ওয়েবসাইটে পুকুরটির বয়স ১৪০০ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।
আলতাদীঘি পুনর্খনন প্রকল্পের কিছু নথি দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এসেছে। নথিতে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের অর্থায়নে এ প্রকল্প শুরুর আগে জীববৈচিত্র্য, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়ে কোনো প্রাক-সমীক্ষা হয়নি।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুজ্জামান শাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫০ কোটি টাকার নিচের প্রকল্পে এ ধরনের সমীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়।'
এই প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যাকুমেন আর্কিটেক্টস অ্যান্ড প্ল্যানার্স লিমিটেড।
যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ তাহের ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন দেখি পুকুরটি শুকিয়ে আছে এবং সেখানে কাদা ছাড়া কিছু নেই।'
৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকার 'আলতাদীঘি পুনর্নির্মাণ করে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ' শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে পুকুর নিষ্কাশনের জন্য ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং পুকুর খননে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৭২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।
যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এবিএম মহসিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুকুরটি শুকিয়ে গেলে সেখানকার সব জলজ প্রাণী মারা যাবে।'
রাজশাহীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, 'এ প্রকল্প না হলে আলতাদীঘি হয়ত অস্তিত্বহীন হয়ে যেত। কারণ এর গভীরতা ছিল তিন ফুটের কম এবং এটি শাপলা ও কচুরিপানায় ভরে গিয়েছিল।'
প্রকল্প নথি থেকে জানা যায়, সেখানে গাছ কাটার কোনো বিষয় ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইল রফিকুজ্জামান বলেন, 'গাছ কাটা ছাড়া পুনর্খনন ও সংস্কারকাজ সম্ভব ছিল না।'
সেখানে ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনি গাছ ছিল। নতুন করে সেখানে ৩ হাজার স্থানীয় জাতের গাছ লাগানো হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, গাছ কেটে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকায় বিক্রি করা হয় এবং আইন অনুযায়ী ৪৫ শতাংশ টাকা সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির ১৬ জন উপকারভোগীর মধ্যে বিতরণ করা হয়।
রাবি পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, 'ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছ লাগানো ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ এই ধরনের গাছ লাগানো ও কাটা দুর্নীতির একটি অতিপরিচিত প্রক্রিয়া।'
'কেন তারা প্রথমে ওই গাছগুলো লাগিয়েছিল? দ্বিতীয়ত, কেন তারা এই গাছগুলো কাটার আগেই স্থানীয় জাতের গাছ লাগালো না,' প্রশ্ন করেন অধ্যাপক সাবরিনা নাজ।
স্থানীয়দের কেউ এই প্রকল্পের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
স্থানীয় কৃষক লুৎফর রহমান (৬০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলতাদীঘিতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর বসবাস ছিল। আমি সেখানে শিয়াল, বেজি, মেছো বাঘ, সাপ, বড় মাছ এবং এমনকি পরিযায়ী পাখি দেখেছি। ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোয় এগুলো অনেক আগেই নাই হয়ে গেছে এবং পুকুর গভীরতা হারিয়েছে।'
'এই গ্রীষ্মে ওই প্রকল্পের জন্য আমাদের প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পেতে হয়েছে। আশা করি পুনর্খনন হলে আলতাদীঘিতে প্রাণ ফিরে আসবে,' বলেন তিনি।
১৯৭২ সালে আলতাদীঘি একবার পুনর্খনন করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯৫ শতাংশ শেষ এবং পুকুরের গভীরতা এখন আড়াই মিটার বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
তিনি বলেন, 'কাজ শেষ হলে আলতাদীঘি আবার সবুজ হয়ে উঠবে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।'
অধ্যাপক এবিএম মহসিন অবশ্য বলেছেন, 'আলতাদীঘির আগের পরিবেশ ফিরে পেতে কত সময় লাগবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সমীক্ষা প্রয়োজন।'
Comments
Post a Comment