বাংলাদেশের নতুন পাখি ‘জঙ্গল আউলেট’ ছোট কালি পেঁচা
ছবি তুলেছেন অধ্যাপক সালেহ রেজা
প্রতিদিনের মতো গত ১৩ অক্টোবর সকালে ক্যাম্পাসে হাঁটতে বের হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা। তার প্রাতঃভ্রমণ অন্যান্য সকালগুলোর চেয়ে ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সেদিন অদ্ভুত এক পাখির ডাক শুনে হঠাৎ করে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে শুরু করলেন অধ্যাপক রেজা।
তিনি যে পাখিটির ডাক শুনেছিলেন পরের দুই সপ্তাহে প্রমাণ করেন, সেটা একটি 'জঙ্গল আউলেট'। তিনিই দেশে প্রথমবারের মতো এই প্রজাতির পেঁচা দেখলেন। যেহেতু দেশে প্রথমবার দেখা গেল, তাই এর বাংলা নাম পাওয়া যায় না। তবে, পাখি প্রেমীরা নতুন এই পাখিকে 'ছোট কালি পেঁচা' বলে ডাকছেন।
অধ্যাপক রেজা শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন আমি এটির ডাক শুনি, তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, এই ডাক আমি আগে কখনো শুনিনি। এরপর নতুন এই পাখির ডাকের অনুসন্ধান শুরু করলাম এবং প্যারিস রোডের একটি আম গাছে বসে থাকা পাখিটিকে আবিষ্কার করলাম।'
পাখিপ্রেমী সালেহ রেজা সকালে হাঁটার সময় বরাবরের মতো সঙ্গে নেন একটা ক্যামেরা আর ৪০০ মিলিমিটার জুম লেন্স। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে গাছ গাছালিতে ভরা ক্যাম্পাসে গাছের ডালে নানা রকমের পাখির ছবি তুলতে থাকেন।
তিনি বলছিলেন, 'এটি একটি ছোট পেঁচা ছিল। যার সমস্ত শরীরে ঘন বাদামি ডোরাকাটা রেখা আছে, পাখায় বাদামি রেখাগুলো সুনিপুন চিত্রকলার মতো মনে হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যান্য অনেক প্রজাতির পেঁচা থেকে একে আলাদা করেছে।'
''পাখিটি উচ্চস্বরে ডাকছিল, যেটা বারবেটের চেয়েও তীব্র, সেইসঙ্গে একটি মিষ্টি 'কাও-কাও-কাহ-ওও' আওয়াজ।'
তিনি পাখিটির ছবি তুলে পাখি শনাক্তকরণ গ্রুপগুলিতে পোস্ট করেছেন এবং এটা পাখি ডেটাবেসে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
তিনি যখন পাখি গবেষকদের নতুন এই পাখির ছবিগুলো দেখেছিলেন, তারা বিশ্বাস করতে পারেননি। তারা অধ্যাপককে পাখির ডাকের রেকর্ডিং সংগ্রহ করতে বলেন।
এরপরই আবার পাখির খোঁজে বের হন ৫৫ বছর বয়সী অধ্যাপক রেজা। গত ১৫ অক্টোবর এটি খুঁজে পাওয়ার পরে, তিনি পাখির ডাক রেকর্ড করতে সক্ষম হন।
তার পরেও পাখির পরিচয় নিশ্চিত করতে পাখি গবেষকগরা নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না।
পরে আরও অনেকবার অধ্যাপক রেজা পাখিটিকে খুঁজে বের করেন এবং পাখির পিঠ ও অন্য নানান আঙ্গিকের ছবি সংগ্রহ করেন।
প্রয়োজনীয় সব প্রমাণ সংগ্রহ শেষে গত ২৭ অক্টোবর পাখি গবেষকগরা পাখিটির প্রজাতি নিশ্চিত করে বলেন যে, পাখিটি পেঁচার একটি প্রজাতি। যার নাম জঙ্গল আউলেট, বৈজ্ঞানিক নাম (Glaucidium radiatum)।
ছবি তুলেছেন অধ্যাপক সালেহ রেজা
'জঙ্গল আউলেট হল একটি বন্য পেঁচার প্রজাতি, যা ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায়', দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন অধ্যাপক রেজা।
পাখি গবেষকগরা ১৯৫১ সাল থেকে দেশে এর ডাক শোনার কথা বলে আসছিলেন, কিন্তু এর আগে কথনো এই পাখি ডাটাবেসে নথিভুক্ত হয়নি।
প্রফেসর সালেহ রেজা বলেন, 'রাবির প্যারিস রোডের আম ও গগন সিরিশ গাছগুলোতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এই পেঁচা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে।' তিনি মনে করেন, তিনি এই নতুন প্রজাতির পাখির এক জোড়াকে দেখেছেন।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পাখি বিশেষজ্ঞরা, বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান এবং বার্ডস বাংলাদেশের পল থম্পসন এবং সায়াম ইউ চৌধুরী পাখিটির পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
তারা বলেন, 'নতুন এই পাখির প্রজাতির আবিষ্কার বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের পরিচয় বহন করে এবং দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় গভীর মনোযোগের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।'
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক রেজা বলেন, 'সারা বিশ্বে মোট ২৫০ প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১৮ প্রজাতির পেঁচা রয়েছে। শুধু রাবি ক্যাম্পাসেই ৬ জাতের পেঁচা তাদের আবাসস্থল তৈরি করেছে, যা এখন নতুন প্রজাতির সংযোজনের ফলে ৭টিতে পৌঁছাল।'
Comments
Post a Comment