শখের বশে মাছ ধরতে গিয়ে নতুন পেশার সন্ধান | আকিবের মাছ ধরার টোপ, চার রপ্তানি হচ্ছে এশিয়া ও ইউরোপে
সম্প্রতি এক বিকেলে শহরের মোল্লাপাড়ার একটি পুকুরে মাছ ধরছিলেন রাজশাহীর উদ্যোক্তা এইচ আতাউর রহমান আকিব। মাছ ধরার জন্য নিজের কারখানায় তৈরি টোপ ও চার ব্যবহার করছিলেন তিনি। প্রতিবারই বড় বড় মাছ তার ছিপে আটকা পড়ছিল। কিন্তু ধরার সঙ্গে সঙ্গে সব মাছই আবার পুকুরে ছেড়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
'মাছ ধরা আমার শখ। এত মাছ আমার প্রয়োজন নেই। বরং আমার টোপ ও চার যে মাছকে বোকা বানাতে পারছে এটা দেখতে পারাতেই আমার সার্থকতা'- বলছিলেন আকিব।
গত এপ্রিলে আকিবের সঙ্গে তার অফিসে, মাছ ধরার পুকুর পাড়ে ও কারখানায় বসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
মাছ শিকারের এমন নৈতিক ধারণা পাঁচ বছর আগে দেশে আকিবই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম প্রচার শুরু করেন বলে জানান। তবে সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি। শখের বশে তার মাছ ধরার নেশা থেকে নতুন এক পেশার সন্ধানও পেয়েছেন তিনি।
রাজশাহী শহরের ঠাকুরমারা এলাকায় তার বাসভবন প্রাঙ্গণে টোপ ও চার তৈরির একটি কারখানা স্থাপন করেছেন। সেখানে প্রচলিত রাসায়নিক ও ক্ষতিকর পদ্ধতির বদলে তিনি বাণিজ্যিকভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব টোপ ও চার তৈরি করছেন।
৪ বছরে আকিবের প্রতিষ্ঠান 'প্রিমিটিভ ফিশিং বাই আকিব' এর তৈরি টোপ ও চারের জনপ্রিয়তা শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
তার কারখানার কারেন্ট চার, রেডি টোপ, জাফরানি ছাতু সবচেয়ে জনপ্রিয়। আগুনজল নামে একটি ফেরোমন স্প্রে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশে আকিবের কারখানাতেই তৈরি হয়।
'আমরা এখন ভারতে এবং নিউজিল্যান্ডে আমাদের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নিয়েছি,' বলেন আকিব।
তিনি জানান, চার বছর বয়স থেকেই মাছ শিকারের ঝোঁক তৈরি হয়। ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় পাড়ি দেন নিউজিল্যান্ডে। তবে কোথাও শখের মাছ ধরা বন্ধ রাখেননি।
অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য ও প্রযুক্তিতে মাস্টার্স করেন। পরিবেশবিদ্যায় একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। সেখানেই ক্যারিয়ার গড়তে শুরু করেছিলেন। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাবা-মায়ের ডাকে ফিরে আসেন দেশে, রাজশাহীতে।
দেশে ফিরে তিনি লক্ষ্য করেন, অপরিকল্পিত মাছ ধরার ফলে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। মাছ ধরার জন্য পিঁপড়ার ডিমের যথেচ্ছ ব্যবহারে পিঁপড়ার মতো অপরিহার্য এক প্রজাতিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
তিনি আরো দেখেন যে মাছের উৎপাদন ও মাছ ধরার জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিকও অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আকিব বলেন, পিঁপড়ার ডিমের চাহিদা এত বেশি যে সপ্তাহের শুরুতে যে ডিম বিক্রি হয় ৩০০ টাকা কেজি দরে, সপ্তাহান্তে ছয় থেকে দশ গুণ দাম বেড়ে যায়, অনেক সময় পাওয়াই যায় না।
আকিব নিজেও পিঁপড়ার ডিম ও প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ ধরতেন। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার মাছ ধরা এবং পরিবেশবিদ্যার অভিজ্ঞতা তাকে সবকিছু ভিন্নভাবে ভাবতে সহায়তা করেছিল।
তিনি বলেন, 'আমি চিন্তায় পরলাম, এভাবে চলতে থাকলে তো প্রকৃতি থেকে পিঁপড়া এক সময় হারিয়ে যাবে! আমি দেরি না করে বিকল্প খুঁজতে শুরু করলাম।'
তিনি খুঁজে বের করলেন, পিঁপড়ার ডিমের যে উপাদানের কারণে মাছ আকৃষ্ট হয় সেই উপাদান আরও অনেক প্রাকৃতিক বস্তুতে পাওয়া যায় এবং সেসব বস্তুতেও মাছ একইভাবে আকৃষ্ট হয়।
এভাবেই প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে তার পরিবেশবান্ধব টোপ ও চার বানানো শুরু।
প্রথমে দেশের ও পরে ভারত, পাকিস্থান, নেপাল ও অন্যান্য দেশের ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষীর সৌখিন মাছ শিকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন।
'কিন্তু তখনও বাণিজ্যক চিন্তা মাথায় আসেনি। শখেই সবকিছু করছিলাম' বলেন এই উদ্যোক্তা।
তার চিন্তাধারা পরিবর্তন আসতে শুরু করে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে যখন ঢাকার একজন সৌখিন মাছ শিকারি আকিবকে ২ হাজার টাকা পাঠান। তিনি তার জন্য অকিবকে টোপ ও চার তৈরি করে দিতে বলেন।
আকিব বলেন, 'এই ২ হাজার টাকাতেই আমার শুরু। এরপর চাহিদা বাড়তে থাকে, আমিও ব্যবসায়িকভিত্তিতে টোপ ও চার বানাতে শুরু করি। আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। শখের নেশা এখন আমার পেশা হয়ে গেছে।
'ব্যবসা করতে গিয়ে দেখলাম, মাছ ধরার টোপ ও চারের একটি বড় বাজার শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও আছে। কিন্তু দেশে কেউ আমার আগে কোনো উদ্যোগ নেননি।'
আকিব জানান, আগেও মাছ ধরতে প্রয়োজনীয় পণ্য বেচাকেনার প্রচলন দেশে ছিল, কিন্তু সেগুলো আনুষ্ঠানিক কিছু ছিল না। তিনিই প্রথম তার কারখানার প্রত্যেকটি টোপ ও চার সংশ্লিষ্ট সরকারি গবেষণাগারে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে পরিবেশবান্ধব সনদ নেন। পরে সেসব পণ্য বিক্রি ও রপ্তানির জন্য অনুমোদন পান।
আকিবের জন্য ২০১৯ সাল ছিল ঘটনাবহুল
তিনি দেশের সৌখিন মাছ শিকারিদের নিয়ে একটি ক্লাব গড়ে তোলেন এবং ক্লাবটিকে ইন্টারন্যাশনাল গেম ফিশিং অ্যাসোসিয়েশনভূক্ত করেন ২০১৯ সালে।
একই বছরে তিনি সৌখিন মাছ শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর প্রস্তুতকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং তার প্রতিষ্ঠান দেশের প্রথম গেম ফিশিং প্রস্তুতকারক হিসেবে অনুমোদন পায়।
ওই বছরই তিনি তার উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি শুরু করেন। আবার, হাতে কলমে মাছ শিকারের প্রশিক্ষণও দিতে শুরু করেন।
একই বছরে আকিব সুস্থধারার মাছ শিকার অভ্যাসের প্রচারের জন্য 'এক টাকার টিকিটে' মাছ ধরার উৎসবের আয়োজন করেন। এই উৎসবে যোগ দিতে মাছ শিকারিদের এক টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয়েছিল, কিন্তু তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো মাছ বাড়ি নিতে পারেননি, মাছ ধরে আবার পুকুরেই ছেড়ে দিতে হয়।
পরের দুই বছর আকিবের টোপ ও চারের ব্যবসা বাড়তে থাকে। তিনি তার কারখানা ছোট একটা ঝুপরি ঘর থেকে আধুনিক কারখানায় রূপ দেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আকিবের লেখা 'ছিপ বড়শি' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এপ্রিলে তিনি ভারতের কলকাতায় ইন্দো-বাংলা মৈত্রী সম্মান পুরস্কার অর্জন করেন।
আকিব একদিন তার বাসার পুকুর থেকে একটি কাতল মাছ তুলে এই প্রতিবেদকের হাতে দেন এবং এর অনুভূতি জানতে চান।
মাছটি প্রচন্ড শক্তিতে পানিতে ফিরে যেতে চাইছিল, দুই হাতেও মাছটাকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না।
আকিব মাছটি পুকুরে ছেড়ে দিয়ে বলেন, 'মাছের এই প্রাণশক্তিকে আপনার মানতেই হবে। মাছের প্রজাতি এবং আমাদের চারপাশের প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার কথা ভুললে চলবে না।'
Comments
Post a Comment