যে কারণে হত্যা করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবি মীর আব্দুল কাইয়ূমকে
রাত তখন ৮টা। একাত্তরের শেষ দিকে শীতের রাতে ভয়াবহ নীরবতা ভেদ করে রাজশাহীর ঘোড়ামারা এলাকার এফ-১২৩৭ নম্বর বাড়ির দরজায় হঠাৎ কড়া নড়ে উঠলো।
এ ধরনের কড়া নড়ার শব্দ যেন না শুনতে হয় তার জন্যই মীর আব্দুল কাইয়ূম স্ত্রী পরিবারসহ নিজ বাড়ি ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু শব্দটা এড়াতে পারেননি।
দরজার পিছনে একজন পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্যার, আপনি কি বাইরে আসবেন?' তার নরম কণ্ঠে বিনয় থাকলেও সে সময়ে শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ূম ঠাণ্ডায় আক্রান্ত ছিলেন। তার ৭ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী মাসতুরা খানম, যিনি একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, তাকে ওই ডাকে সাড়া দিতে না করেন।
কিন্তু কাইয়ূম ভীতিকর ওই ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখেননি। তিনি তার পরিচয়পত্রটি হাতে নিয়ে দরজা খুলে দেন। দেখতে পান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের অবাঙালি স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী দরজায় দাড়িয়ে আছেন। তৈয়ব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
'স্যার, একজন সেনা ক্যাপ্টেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি গলির শেষে তার গাড়িতে অপেক্ষা করছেন,' তৈয়ব বলেন।
'আচ্ছা, চলুন,' কাইয়ূম জবাব দিয়ে তৈয়বকে অনুসরণ করেন।
তখন তার বয়স হয়েছিল ৩২। তিনি মুক্তচিন্তা ও ছাত্র রাজনীতিতে তার মতামতের জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। একাত্তরের ২৫ নভেম্বরের সেই রাতে যে তাকে বাসা থেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে ধরে নিয়ে গেলেন, তারপরে তিনি আর কখনও ফিরে আসেননি।
তিনি সেইসব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, যাদেরকে স্বাধীনতার কয়েকদিন আগে একই কায়দায় ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর বাহিনীর মাধ্যমে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিধন করে শিগগির জন্ম হতে চলা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া যাবে এবং এ দেশের প্রগতি রুখে দেওয়া যাবে।
কাইয়ূম সেই ভয়ঙ্কর নীল নকশার অন্যতম শিকার। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার মরদেহ শ্রীরামপুরের বাবলাবন গণকবরে পাওয়া যায়।
একাত্তরে ২৫ নভেম্বর রাতে কাইয়ূমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দিনটিকেই তার প্রয়াণ দিবস ধরে নিয়ে রাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগ আজ বৃহস্পতিবার 'শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম স্মরণসভা'র আয়োজন করেছে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ সিনেট ভবনে অনুষ্ঠেয় এই আয়োজনে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ইমিরেটাস অরুণ কুমার বসাক। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।
বাংলাপিডিয়া অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় কাইয়ূম ছাড়াও প্রায় ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং অন্যান্য ১৬ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।
অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া। ছবি: সংগৃহীত
কাইয়ূমের কন্যা অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুক্তচিন্তা ও ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছিল, তখন মীর আবদুল কাইয়ূম তার একাডেমিক গবেষণার জন্য সেই বিষয়গুলো বেছে নেওয়ার সাহস করেছিলেন।'
অধ্যাপক কেয়া এখন তার বাবা-মায়ের বিভাগ মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। একাত্তরে তিনি মাত্র ৫ বছর বয়সী ছিলেন। কাইয়ূমের ৪ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
'আমার বাবা তার অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে জানতেন এবং তিনি তার পরিবারকে তার আসন্ন ভাগ্য থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন,' বলেন অধ্যাপক কেয়া।
তিনি জানান, সেই রাতের ঘটনা এবং তার বাবার কথা মা ও মামা বীর মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাফিজুর রহমান খান আলমের কাছে শুনেছেন। তিনি তার বাবার ডায়েরিও পড়েছিলেন এবং তার বাবার নাম উল্লেখ আছে এমন নথিপত্র পড়েছেন।
'বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, তবে আমার সন্দেহ হয় যে সেদিন আমি বেঁচে থাকব কি না,' কথাগুলো তার বাবা পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন বলে জানান কেয়া।
তিনি আরও বলেন, 'বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় প্রচণ্ড ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি কি করছেন সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তা না হলে কীভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন এবং একই সঙ্গে তার নিজের জীবন নিয়ে এতটা অনিশ্চিত ছিলেন?'
যুদ্ধ শুরু হলে কাইয়ূম ও তার পরিবার ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর মালোপাড়া এলাকায় একটি ৩তলা ভবনের উপরের তলায় ভাড়া থাকতেন।
১৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী দখল করার আগে কাইয়ূম তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাঘা উপজেলার আলাইপুর এলাকায় স্ত্রীর গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তিনি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংস্পর্শে ছিলেন এবং তাদের ভাড়া করা শহরের ফ্ল্যাটটি তাদের ব্যবহারের জন্য খোলা রাখেন।
কিন্তু কর্মস্থলে যোগদানের জন্য রেডিওতে সরকারি ঘোষণার পরে কাইয়ূমকে শহরে ফিরে আসতে হয়েছিল।
'শহরে ফিরে আমরা দেখতে পেলাম যে আমাদের ফ্ল্যাটটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তানের সেনাসদস্যরা কাছের টিএন্ডটি অফিসে ক্যাম্প করেছে।'
এরপরে কাইয়ূম ঘোড়ামারা এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। সেখান থেকেই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
শিক্ষকতার পাশাপাশি কাইয়ূম মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে গোপনে সময় ব্যয় করতেন।
'আমার বড় ভাই একবার বাবাকে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলতে দেখেছিল…। তারপরে আমার বাবা আমার ভাইকে এ বিষয়ে কাউকে না বলার জন্য বলেছিলেন।'
মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও কাইয়ূম আইন ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যয়ন শুরু করেন।
অধ্যাপক কেয়া জানান, তিনি মুক্তচিন্তা ও ছাত্রদের রাজনীতি নিয়ে গবেষণার জন্য উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার গবেষণার কিছু রেকর্ড রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগীদের দিয়ে পূর্ণ ছিল। তারা বাঙালি শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তাদের সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অবহিত করতেন।
'তারা আমার বাবার একাডেমিক কার্যক্রম সম্পর্কে পুরোপুরি জানতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তার সহযোগীদের কেউ তাকে শনাক্ত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল,' বলেন কেয়া।
১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর শহরের শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মা নদীর তীরে বাবলা বন গণকবরে কাইয়ূমের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল। গণকবরে তার বাবার মরদেহসহ কমপক্ষে ১৪টি মরদেহ পাওয়া যায়।
কাইয়ূমের শ্যালক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফিজুর রহমান খান আলম তার মরদেহ শনাক্ত করেন।
তিনি বলেন, 'সবার ঘাড়ে ও কোমর একটিমাত্র দড়িতে বাঁধা ছিল। তাদের কারো শরীরে কোনো বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল না। ধারণা করা হয় তাদের ১৪ জনকে একই সঙ্গে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল।'
কাইয়ূমকে পরে হেতম খা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
একাত্তরের ডিসেম্বরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আল-বদর বাহিনীর নৃশংসতা চরমে উঠেছিল। তারা নিয়মিতভাবে শিক্ষক, লেখক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে এবং মরদেহগুলো বিভিন্ন স্থানে চাপা দিয়ে রাখে।
এ ধরনের কড়া নড়ার শব্দ যেন না শুনতে হয় তার জন্যই মীর আব্দুল কাইয়ূম স্ত্রী পরিবারসহ নিজ বাড়ি ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু শব্দটা এড়াতে পারেননি।
দরজার পিছনে একজন পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্যার, আপনি কি বাইরে আসবেন?' তার নরম কণ্ঠে বিনয় থাকলেও সে সময়ে শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ূম ঠাণ্ডায় আক্রান্ত ছিলেন। তার ৭ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী মাসতুরা খানম, যিনি একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, তাকে ওই ডাকে সাড়া দিতে না করেন।
কিন্তু কাইয়ূম ভীতিকর ওই ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখেননি। তিনি তার পরিচয়পত্রটি হাতে নিয়ে দরজা খুলে দেন। দেখতে পান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের অবাঙালি স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী দরজায় দাড়িয়ে আছেন। তৈয়ব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
'স্যার, একজন সেনা ক্যাপ্টেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি গলির শেষে তার গাড়িতে অপেক্ষা করছেন,' তৈয়ব বলেন।
'আচ্ছা, চলুন,' কাইয়ূম জবাব দিয়ে তৈয়বকে অনুসরণ করেন।
তখন তার বয়স হয়েছিল ৩২। তিনি মুক্তচিন্তা ও ছাত্র রাজনীতিতে তার মতামতের জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। একাত্তরের ২৫ নভেম্বরের সেই রাতে যে তাকে বাসা থেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে ধরে নিয়ে গেলেন, তারপরে তিনি আর কখনও ফিরে আসেননি।
তিনি সেইসব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, যাদেরকে স্বাধীনতার কয়েকদিন আগে একই কায়দায় ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর বাহিনীর মাধ্যমে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিধন করে শিগগির জন্ম হতে চলা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া যাবে এবং এ দেশের প্রগতি রুখে দেওয়া যাবে।
কাইয়ূম সেই ভয়ঙ্কর নীল নকশার অন্যতম শিকার। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার মরদেহ শ্রীরামপুরের বাবলাবন গণকবরে পাওয়া যায়।
একাত্তরে ২৫ নভেম্বর রাতে কাইয়ূমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দিনটিকেই তার প্রয়াণ দিবস ধরে নিয়ে রাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগ আজ বৃহস্পতিবার 'শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম স্মরণসভা'র আয়োজন করেছে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ সিনেট ভবনে অনুষ্ঠেয় এই আয়োজনে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ইমিরেটাস অরুণ কুমার বসাক। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।
বাংলাপিডিয়া অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় কাইয়ূম ছাড়াও প্রায় ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং অন্যান্য ১৬ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।
অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া। ছবি: সংগৃহীত
কাইয়ূমের কন্যা অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুক্তচিন্তা ও ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছিল, তখন মীর আবদুল কাইয়ূম তার একাডেমিক গবেষণার জন্য সেই বিষয়গুলো বেছে নেওয়ার সাহস করেছিলেন।'
অধ্যাপক কেয়া এখন তার বাবা-মায়ের বিভাগ মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। একাত্তরে তিনি মাত্র ৫ বছর বয়সী ছিলেন। কাইয়ূমের ৪ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
'আমার বাবা তার অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে জানতেন এবং তিনি তার পরিবারকে তার আসন্ন ভাগ্য থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন,' বলেন অধ্যাপক কেয়া।
তিনি জানান, সেই রাতের ঘটনা এবং তার বাবার কথা মা ও মামা বীর মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাফিজুর রহমান খান আলমের কাছে শুনেছেন। তিনি তার বাবার ডায়েরিও পড়েছিলেন এবং তার বাবার নাম উল্লেখ আছে এমন নথিপত্র পড়েছেন।
'বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, তবে আমার সন্দেহ হয় যে সেদিন আমি বেঁচে থাকব কি না,' কথাগুলো তার বাবা পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন বলে জানান কেয়া।
তিনি আরও বলেন, 'বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় প্রচণ্ড ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি কি করছেন সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তা না হলে কীভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন এবং একই সঙ্গে তার নিজের জীবন নিয়ে এতটা অনিশ্চিত ছিলেন?'
যুদ্ধ শুরু হলে কাইয়ূম ও তার পরিবার ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর মালোপাড়া এলাকায় একটি ৩তলা ভবনের উপরের তলায় ভাড়া থাকতেন।
১৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী দখল করার আগে কাইয়ূম তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাঘা উপজেলার আলাইপুর এলাকায় স্ত্রীর গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তিনি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংস্পর্শে ছিলেন এবং তাদের ভাড়া করা শহরের ফ্ল্যাটটি তাদের ব্যবহারের জন্য খোলা রাখেন।
কিন্তু কর্মস্থলে যোগদানের জন্য রেডিওতে সরকারি ঘোষণার পরে কাইয়ূমকে শহরে ফিরে আসতে হয়েছিল।
'শহরে ফিরে আমরা দেখতে পেলাম যে আমাদের ফ্ল্যাটটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তানের সেনাসদস্যরা কাছের টিএন্ডটি অফিসে ক্যাম্প করেছে।'
এরপরে কাইয়ূম ঘোড়ামারা এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। সেখান থেকেই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
শিক্ষকতার পাশাপাশি কাইয়ূম মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে গোপনে সময় ব্যয় করতেন।
'আমার বড় ভাই একবার বাবাকে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলতে দেখেছিল…। তারপরে আমার বাবা আমার ভাইকে এ বিষয়ে কাউকে না বলার জন্য বলেছিলেন।'
মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও কাইয়ূম আইন ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যয়ন শুরু করেন।
অধ্যাপক কেয়া জানান, তিনি মুক্তচিন্তা ও ছাত্রদের রাজনীতি নিয়ে গবেষণার জন্য উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার গবেষণার কিছু রেকর্ড রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগীদের দিয়ে পূর্ণ ছিল। তারা বাঙালি শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তাদের সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অবহিত করতেন।
'তারা আমার বাবার একাডেমিক কার্যক্রম সম্পর্কে পুরোপুরি জানতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তার সহযোগীদের কেউ তাকে শনাক্ত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল,' বলেন কেয়া।
১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর শহরের শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মা নদীর তীরে বাবলা বন গণকবরে কাইয়ূমের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল। গণকবরে তার বাবার মরদেহসহ কমপক্ষে ১৪টি মরদেহ পাওয়া যায়।
কাইয়ূমের শ্যালক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফিজুর রহমান খান আলম তার মরদেহ শনাক্ত করেন।
তিনি বলেন, 'সবার ঘাড়ে ও কোমর একটিমাত্র দড়িতে বাঁধা ছিল। তাদের কারো শরীরে কোনো বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল না। ধারণা করা হয় তাদের ১৪ জনকে একই সঙ্গে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল।'
কাইয়ূমকে পরে হেতম খা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
একাত্তরের ডিসেম্বরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আল-বদর বাহিনীর নৃশংসতা চরমে উঠেছিল। তারা নিয়মিতভাবে শিক্ষক, লেখক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে এবং মরদেহগুলো বিভিন্ন স্থানে চাপা দিয়ে রাখে।
Comments
Post a Comment