পানির ফাঁদে বরেন্দ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক









কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারির অভাবে অনেক গভীর নলকূপ অপারেটর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ক্ষুদ্র কৃষকদের তাদের সেচের ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করছে।

গ্রীষ্ম মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট দেখা দেয়। সেইসময়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নলকূপ অপারেটররা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সেচের পানির জন্য দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকে।
অপারেটরা তাদের পাম্প থেকে পানি দিতে দেরি করে, এতে ক্ষুদ্র কৃষকেরা ঘন ঘন ফসলের ক্ষতির মুখে পরে। তারা এমন এক ফাঁদে পরে যায় যে একসময় আর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। বাধ্য হয় নিজের জমি বিক্রি করে দিতে বা অন্যের কাছে জমি লিজ দিতে।

অনেকে বেঁচে থাকার জন্য কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুরে পরিণত হন। অনেকক্ষেত্রে নলকূপ অপারেটররা যাদের অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাব আছে তারা এই জমিগুলো কিনে নেয় বা নিজেদের ফসল ফলানোর জন্য ইজারা নেয়।
দ্য ডেইলি স্টার বরেন্দ্র অঞ্চলের বেশ কয়েকজন কৃষক, কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
তারা বলেছেন, সচ্ছল কৃষক বা বহিরাগত ব্যবসায়ী যারা গ্রামে বিপুল পরিমান জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ করে, নলকূপ অপারেটররা অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে তাদের সময়মতো সেচের পানি দেয়। এজন্য তারা অনেক সময় নলকূপের আওতাভূক্ত জমির বাইরে গিয়ে হলেও বড় কৃষকদের সেচের পানি দেয় ক্ষুদ্র কৃষকদের বঞ্চিত করে।
এরকম এক গভীর নলকূপ চালকের হয়রানীর প্রতিবাদে গত বুধবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ইশ্বরীপুর গ্রামে জমির গভীর নলকূপের পাশে দাঁড়িয়ে কীটনাশক পান করেন দুই কৃষক। তাদের একজন, অভিনাথ মার্ডি (৩৬) সেই রাতেই মারা যান এবং অন্যজন রবি মার্ডি (২৭), শুক্রবার মারা যান। তারা ছিলেন চাচাতো ভাই এবং সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর।

Abhinath Mardi                                                     Robi Mardi

এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম বাদী হয়ে নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে আসামি করে স্বামীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে গোদাগাড়ী থানায় একটি মামলা করেন।
মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, সেচের পানি চাইবার পরও সাখাওয়াত টানা ১২ দিন অভিনাথের খেতে পানি সরবরাহ করেনি। তবে অভিনাথের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরলে নলকূপ অপারেটর তাদের দুজনের জমিতে সারারাত পানি দিয়েছে।
ঘটনাটি নিয়ে কথা বলতে গেলে শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, 'আমরা লক্ষ্য করেছি বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে সেচের পানি নিয়ে এক ধরনের সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হচ্ছে।'
'কৃষকরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে এই সামন্তবাদীদের কাছে ফসল এবং জমি হারাচ্ছে,' তিনি বলেন এবং যোগ করে অনেক নলকূপ অপারেটর এই অঞ্চলের পানি সংকটের সুযোগ নিয়ে কৃষকদের শোষণ করছে।'
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলা, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী এবং নওগাঁর পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলায় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। নওগাঁর কৃষকরা ধান আবাদ ছেড়ে আম আবাদে ঝুঁকে পরলেও, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষুদ্র কৃষকরা সারা বছরের খাবারের জন্য বোরো ধান আবাদ করে থাকেন। বোরো আবাদে অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে বেশি সেচের দরকার হয়।
ইশ্বরিপুর গ্রামের কৃষক বিমল হাসদা জানান, তার বোরো খেতে পানি পেতে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।

'আমার কমপক্ষে দুই ঘণ্টার জন্য পানির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দেওয়া হয়েছিল মাত্র এক ঘণ্টার।'

বিমল এখন আশঙ্কা করছেন তার ফলন খারাপ হতে পারে, যেমনটা গত বছরও হয়েছিল।

'এরকম চলতে থাকলে আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। কৃষি ছাড়া অন্য কাজও জানি না। ফসলের ক্ষতি হলে আমি কী খাব পরিবারকে কী খাওয়াবো,' বলেন বিমল।
বিমল বলেন, 'পানির জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে থাকি। অপারেটরের হাতে পায়ে ধরি। এমনিতেই ফসলের দাম পাওয়া যায় না, তার ওপর পানির অভাবে ফলন কমে গেলে ক্ষতি বেড়ে যায়।'
সত্য মার্ডি বলেন, আদিবাসী কৃষকদের ভোগান্তি অন্য ক্ষুদ্র কৃষকদের থেকে বেশি।
'আমাদের দিনের বেলা কখনোই পানি দেয় না। আবার রাতে পানি দেবে বলে রাতের পর রাত জাগিয়ে রেখে দুই সপ্তাহ পার করে দেয়। আমরা দিনের বেলা কাজ করে রাতেও জমিতে বসে থাকি।'
সরকারের বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ১৬ হাজার গভীর নলকূপ পরিচলনার জন্য অপারেটর নিয়োগ করে এবং নলকূপগুলো থেকে বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে।

বিএমডিএ সূত্র জানায়, এই নলকূপগুলোর অর্ধেকেরও বেশি বরেন্দ্র অঞ্চলের তিন জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁতে যেখানে সেচের পানির অভাব রয়েছে। এগুলো ছাড়াও, বিএমডিএ কর্মকর্তারা জানান, এই তিন জেলায় উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদিত প্রায় ৫৬ হাজার ব্যক্তিগত নলকূপ রয়েছে।
এ অঞ্চলে কর্মরত বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন কর্মীরা বলেন, সরকারি নলকূপগুলোর অপারেটর বা বেসরকারি নলকূপের অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিয়মনীতির চেয়ে অর্থ ও রাজনীতির প্রাধান্যই থাকে।
বেশ কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় পানির পাম্প বসানোর এক বছরের মধ্যেই অপারেটররা অনেক ধনী হয়ে যায়।
গোদাগাড়ীর জগপুর গ্রামের মাজেদ আলী বলেন, 'এ এলাকার নলকূপগুলো অনেকের কাছে তেলের খনির মতো কাজ করে। নলকূপের মালিকরা আমাদের পানি দেয় না, অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে অন্যদের পানি দেয়। এভাবে তারা অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থ উপার্জন করে। আমাদের অনেকে ফসল ফলাতে না পেরে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই। নলকূপ অপারেটররাই আমাদের জমি কিনে নেয়।'
কিছু ক্ষেত্রে, অপারেটররা টাকার বিনিময়ে সচ্ছল কৃষকদের এই ধরনের জমি কিনতে বা লিজ নিতে সাহায্য করে, তিনি বলেন।
পানির জন্য অতিরিক্ত অর্থ ছাড়াও, নলকূপ অপারেটেররা জমিতে পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় নলকূপের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটানোর জন্যও কৃষকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ফসল নেয়। এছাড়া নলকূপ নষ্ট হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকে মেরামত খরচের টাকাও নেয়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী মেরামত খরচ অপারেটরেরই বহন করার কথা।

কৃষকেরা জানান, রাস্তা কেটে তাদের জমিতে যে পানি সরবরাহ করা হয় তার জন্য তাদের বেশি টাকা দিতে হয়।

যেমন ব্যক্তিগত নলকূপের মালিক এক ঘণ্টা পানির জন্য কমপক্ষে ১১০ টাকা চার্জ করে, কিন্তু এতে তাদের খরচ হয় ২৮ টাকার মতো।
সেচের পানি সুষ্ঠু বিতরণের জন্য বিএমডিএ কৃষকদের স্মার্ট কার্ড দিয়েছে। স্মার্টকার্ডে টাকা রিচার্জ করে নলকূপের ঘরে রাখা মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করলে তাদের জমিতে পানি যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে খুব অল্প কয়েকজন নলকূপ অপারেটর কৃষকদের তাদের স্মার্টকার্ড ব্যবহার করতে দেয়। বরং অপারেটররা নিজেদের কার্ড ব্যবহার করে নগদ টাকায় কৃষকদের পানি নিতে বাধ্য করে বলে কৃষকেরা জানান।
যোগাযোগ করা হলে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, তারা এ বিষয়ে কৃষকদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ পান। 'আমরা প্রতি বছর এক বা দুজন অপারেটরকে সরিয়ে দিই, কিন্তু বেশিরভাগ অভিযোগ আসেই না।'
'আমরা বিষয়টি দেখব, বলেন তিনি।
গোদাগাড়ীর কৃষক অভিনাথ মার্ডির আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলার আসামি সাখাওয়াতের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় ইশ্বরিপুর গ্রামে তার বাড়ির সামনে রাস্তায়, তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার একদিন আগে।

তার দোতলা কংক্রিট বাড়িটি ইশ্বরিপুর গ্রামে একমাত্র পাকা বাড়ি। বাড়ির সামনে রাস্তা, রাস্তার অপর পাশেই বিস্তীর্ণ কৃষি জমি শুরু হওয়ার আগেই গভীর নলকূপের ঘর। সাখাওয়াত কৃষকদের সেচের পানি থেকে বঞ্চিত করার কথা অস্বীকার করেছেন।
সাখাওয়াত বলেন, পানির চাহিদা বেড়ে গেলে কিছু কৃষককে অপেক্ষায় থাকতে হয়। এক্ষেত্রে তার কিছু করার থাকে না।

তিনি সাঁওতাল কৃষক অভিনাথের স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, অভিনাথের সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই।

ঘটনার পর পুলিশের সামনে একজন ভ্যানচালক অভিযোগ করেছিলেন যে অভিনাথ কীটনাশক পান করার পর সাখাওয়াত তার নলকূপের নিকট থেকে তার রিকশাতেই অভিনাথকে হাসপাতালে না নিয়ে তাকে তার বাড়িতে রেখে আসেন। এই প্রতিবেদকের কাছে সাখাওয়াত এই অভিযোগও অস্বীকার করে বলেন, 'আমি কিছুই জানি না'।

সাখাওয়াত এই প্রতিবেদককে বলেন তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি এবং তিনি চাইলে তার বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগগুলো আনা হচ্ছে তার প্রতিবাদ আয়োজন করতে পারেন।

Comments

Popular posts from this blog

Smugglers-BDR Affair on Barendra Express

Jessore GOC, pilot killed in chopper crash