রাজশাহীর এক আদালতের অভিমত ফেসবুুক নীতি হতে হবে দেশী সমাজ ব্যবস্থায়

রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল সোমবার এক রায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থা বিবেচনা করে নীতি গ্রহণের অভিমত প্রকাশ করেছে। একইসাথে সাইবার ক্রাইম দমনের ক্ষেত্রে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে নিবিড় সহযোগীতার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। “সাইবার ট্রাইবুনালে আলোচ্য মামলাসহ বিভিন্ন মামলার অভিজ্ঞতা থেকে আদালত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাইবার অপরাধ দমনে ফেসবুককে কি কি করা উচিত সে বিষয়ে বিশদ পরামর্শ দিয়েছেন,” ইসমত আরা বলেন। রায়ে বলা হয়, ফেসবুক বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় একটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে অন্তত চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুক দিনদিন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে।
ফেসবুকে অনেক ভালো কিছু হচ্ছে যেমন নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে প্রতিদিন তরুণরা এগিয়ে আসছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, ব্যবসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, কবিতা-গান ফটোগ্রাফি সিনেমা সহ নানান ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে সৃষ্টিশীল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছে, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করছে। আবার কিছু খারাপ দিকও আছে, যেমন কক্সবাজারের রামু, সিলেটের নাসিরনগর, ভোলাতে বোরহান উদ্দিন ফেসবুক কেন্দ্রিক প্রকাশিত কন্টেন্ট কে কেন্দ্র করে ঘৃণায় বিদ্বেষে রক্ত ঝরেছে, আগুনে জ্বলেছে, গৃহহীন হয়েছে বহু মানুষ। তাই, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কিছু দায়িত্ব রয়েছে যাতে করে ফেসবুক ব্যবহার আরো সুরক্ষিত, ও উন্নত হতে পারে। রায়ে বলা হয়, ‘আমাদের সমাজ, মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধর্মীয় বোধ ও সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক রীতি-নীতি আমাদের মতো, উন্নত দেশের মতো করে একই নীতিতে মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত নয়। তাই আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা বিবেচনায় ফেসবুকে পলিসি নিতে হবে।’ ‘কোনো সাইবার ক্রাইম হলে দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকেই ফেসবুককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তা একত্রে উন্মোচন, উৎঘাটন, দমন ও শান্তি আরোপে পারস্পরিক নিবিড়ভাবে সহযোগিতা কাম্য’ বলেও জানান আদালত। আদালত ফেসবুককে ৩টি সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো হলো- . ফেক আইডি হলো সাইবার অপরাধের সূতিকাগার। একই ব্যক্তির নামে-বেনামে একাধিক আইডি খোলার অপশন চালু রাখা সাইবার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই ফেক আইডি প্রতিরোধে ফেসবুকের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকা কাম্য। . ফেসবুকে পোস্টকৃত কোনো নারী ও শিশুর ছবি বা ভিডিও যাতে অনুমতি ছাড়া কেউ ডাউনলোড করতে না পারে, এমন সিকিউরিটি থাকতে হবে। নারী ও শিশুর ছবি বা ভিডিও বিকৃত করে কেউ যেন ফেসবুক বা মেসেঞ্জারে প্রকাশ ও প্রচার না করতে পারে বা অভব্য কমেন্ট বা শেয়ার না করতে পারে সেজন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর নিরাপত্তা ফিচার জোরদার জরুরি। . কারও ধর্মীয় মূল্যবোধে বা অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এমন কোনো কনটেন্ট প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব দ্রুত উৎঘাটন করে প্রয়োজনে সে ধরনের কনটেন্ট প্রকাশ ও প্রচারে বাঁধা এবং তা দ্রুত অন্তর্জাল হতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। সাইবার ওয়ার্ল্ডকে অস্বীকার করা যাবে না। সার্বিক বিবেচনায় সাইবার বুলিং প্রতিরোধে ফেসবুকের কাছে আরও কার্যকর ভূমিকা কাম্য। আদালত জানান, তাই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সাইবার স্পেসের জন্য শিক্ষা, সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ফেসবুকের উচিত নিরাপদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, অন্তর্জালে কোনটা করা যায় আর কোনটা যায় না, কমেন্ট বা শেয়ার বা ট্যাগ কীভাবে আরও নিরাপদ করা যায়, তা সহজ ভাষায় সহজভাবে শিক্ষণীয় কনটেন্ট আকারে প্রকাশ ও প্রচার করা যাতে করে ইউজাররা দায়িত্বশীল নেটিজেন হতে পারেন বলেও পরামর্শ দিয়েছেন আদালত।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমত আরা বলেন, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ছবি ইচ্ছাকৃতভাবে অসম্মানজনক ও আপত্তিকর ভাবে ফেসবুকে প্রকাশ করার জন্য নাটোর জেলার সিংড়ায় দায়ের করা একটি মামলার রায় ঘোষণা করার সময় ট্রাইবুনালের বিচারক জিয়াউর রহমান এই পরামর্শগুলো দিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর ২, ২০১৫ তে নাটোরের সিংড়া উপজেলার জনৈক আখতার হোসেন তার নিজ নামের ফেসবুক আইডি হতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ছবি ইচ্ছাকৃতভাবে অসম্মানজনক ও আপত্তিকরভাবে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করে। পরেরদিন বিষয়টি নিয়ে জনৈক মখলেছুর রহমান সিংড়া থানায় আখতার হোসেনের বিরুদ্ধে নামে মামলা করে। পুলিশ মামলা তদন্ত করে মার্চ ৮, ২০১৬ তে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারায় চার্জশিট দেয়। দুই মাস পর মামলাটি রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। বিচারে আদালত দেখতে পায় যে আসামি আক্তার হোসেন তিন দফায় অপরাধ সংগঠিত করেছে। রায়ে আসামী আকতার হোসেনকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড করা হয় এবং অনাদায়ে আরও তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। রায়ে বলা হয়, আমাদের সমাজে নারীদের কে ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝে মধ্যেই অসম্মান ও অপমানজনক ভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, তিনিও এমন ঘৃণ্য কর্মকান্ডের শিকার হয়েছেন। এমনটি হয় নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাবের কারনে, যথার্থ শিক্ষার অভাবে। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, সাধারণ একজন নারীরও ডিগনিটি আছে। প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যা ও অশ্লীল ছবি ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রকাশ ও প্রচার তাই ভীষণ মাত্রার ঘৃণিত অপরাধ। রায়ে আরো বলা হয়, আসামী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক প্রপাগান্ডা একটিভিস্ট। রাজনৈতিক দর্শন থাকা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। রাজনীতি হওয়া উচিত শুভ কাজের প্রতিযোগিতা। রাজনীতি মানুষের জন্য। কিন্তু রাজনীতির নামে নোংরা, অরুচিকর, মিথ্যা, অশ্লীল ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ ও প্রচার নিশ্চয়ই অপরাধ। রায়ে বলা হ্য়, বিকৃত করে ছবি প্রকাশের সময় এমন কাজ করা যে খুবই গর্হিত আসামী তা মনে করেন নাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই ফেসবুক ব্যবহারের নিয়ম নীতি জানেন না। অনেকের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের যথার্থ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা না থাকায় কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক হয়ে উঠেছে যা খুশী তাই করার মত একটি জায়গা। এই মামলার আসামী গ্রামে বাস করেন । যেভাবে তিনি একই ধরনের মিথ্যা অশ্লীল কনটেন্ট একাধিকবার প্রকাশ ও প্রচার করেছেন, স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায়, তিনি দায়িত্বশীল নেটিজেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি।

Comments

Popular posts from this blog

Smugglers-BDR Affair on Barendra Express

Jessore GOC, pilot killed in chopper crash