আদালতের পর্যবেক্ষণ: সমাজ ব্যবস্থাই নারীর প্রতি যৌন অপরাধের অন্যতম কারণ
রাজশাহীর একটি আদালত এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, বাংলাদেশে নারীদের প্রতি যৌন অপরাধের অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশের সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে যৌন অপরাধের শিকার নারীদের অপরাধীদের চেয়ে বেশি দায়ী করা হয়।
আজ মঙ্গলবার বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সংঘটিত যৌন অপরাধের একটি মামলার রায় দেওয়ার সময়, রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জিয়াউর রহমান এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমত আরা।
রায়ে বলা হয়েছে, 'আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করি যেখানে যৌন সংক্রান্ত অপরাধে অপরাধী নয়, ভিকটিম নারীকেই দোষারোপ করা হয়। সমাজ তার গায়ে এমনভাবে কালিমা লেপন করে, যেন তার দোষেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।'
'আমাদের সিস্টেম ভিকটিমকে দায়ী করতে বাধ্য করে সেজন্যই এমন অপরাধ ঘটেছে। যৌন অপরাধের শিকার নারীরা নানান বৈষম্য এবং সামাজিক অবিচারের মুখোমুখি হয় এবং তারা তাদের সমাজে, এমনকি তাদের নিজের পরিবারেও কোণঠাসা হয়ে পড়েন।'
পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমত আরা বলেন, 'আদালত দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য বগুড়ার মামলায় ভিকটিমকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছেন। আদালত ভিকটিমকে ছদ্মনাম (কল্প) রেখে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা ও সম্পন্ন করেছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আদালত ভিকটিমের সাক্ষীর বিবরণের জন্য তাকে আদালতে না হাজির করে বিচারের সময় অন্যান্য প্রসিকিউশন সাক্ষীর উপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রায়ে বিচারক লিখেছেন, দেশের সামাজিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগীর সর্বোত্তম স্বার্থ হচ্ছে তার পরিচয় গোপন রাখা।'
নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ করেছেন আদালত।
ব্রিটেন ও ভারতের উদাহরণ তুলে ধরে বিচারক রায়ে লিখেছেন, 'বাংলাদেশেও ভিকটিমের প্রাইভেসি রক্ষার জন্য একই ধরনের আইন রয়েছে, কিন্তু কিছু সংবাদপত্র,অনলাইন পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে।'
বিচারক লিখেছেন, 'কিছু সংবাদপত্র ভিকটিমের নাম উল্লেখ করে না, কিন্তু এমনভাবে বর্ণনা দেয় যাতে সহজেই ভুক্তভোগীদের চিহ্নিত করা যায়।'
'কোনো কোনো মিডিয়া (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকস ও সোশ্যাল) আইনের এই বিধানকে তোয়াক্কা না করে নামসহ ভিকটিমের ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করছে যা শুধু অনৈতিকই নয়, আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।'
রায়ে বিচারক লিখেছেন, 'আমরা এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে নারী পুরুষ প্রত্যেকে বৈষম্যহীনভাবে সম্মানজনক জীবনযাপন করবে। কিন্তু কোনো কোনো পুরুষ প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে নারীকে পণ্যর মতো ভাবছে।'
'বগুড়ার মামলার ভুক্তভোগীর সঙ্গেও একই ব্যবহার করা হয়েছিল', আদালত রায়ে বলেন।
ভুক্তভোগী কল্প ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় কাহালু উপজেলার ৩৪ বছর বয়সী গোলাম রসুলকে বিয়ে করেন।
১০ দিন পর যখন তিনি জানতে পারেন যে, তার স্বামীর প্রথম স্ত্রী এবং সন্তান আছে, তখন তিনি তাকে তালাক দেন।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে গোলাম রসুল কল্পকে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য জোর করতে থাকে এবং তাকে তার ব্যক্তিগত ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কল্পর বাবা বাড়ির দরজায় তার মেয়ের ছবিসহ একটি খাম পান। পরে তিনি জানতে পারেন যে তার প্রতিবেশীরাও একই ধরনের খাম পেয়েছেন।
দুই দিন পর তার বাবা এ ঘটনায় কাহালু থানায় একটি মামলা করেন। এরপর পুলিশ গোলাম রসুলকে গ্রেপ্তার করে।
১৪ এপ্রিল ২০১৭ সালে গোলাম রসুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এরই মধ্যে গোলাম রসুল হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে পলাতক হয়।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর আসামির অনুপস্থিতিতেই আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গঠন করেন।
আজ মঙ্গলবার মামলার বিচার কাজ শেষ করে আদালত গোলাম রসুলকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। রায়ে অভিযুক্তকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং জরিমানা পরিশোধ করতে না পারলে তাকে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
Comments
Post a Comment